গমের ব্লাস্ট একটি ক্ষতিকর ছত্রাকজনিত রোগ। ছত্রাকটির বৈজ্ঞানিক নাম ম্যাগনাপরথি অরাইজি (পাইরিকুলারিয়া অরাইজি) প্যাথোটাইপ ট্রিটিকাম। গমের শীষ বের হওয়া থেকে ফুল ফোটার সময়ে তুলনামূলক উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া থাকলে এ রোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে। রোগটি ১৯৮৫ সালে সর্বপ্রথম ব্রাজিলে দেখা যায় এবং পরে ব্রাজিলসহ দক্ষিণ আমেরিকার বলিভিয়া, প্যারাগুয়ে, আর্জেন্টিনা এসব দেশে এর বিস্তার হয়। বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৩০ লাখ হেক্টর গমের জমি ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয় এবং ফলন উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে যশোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, বরিশাল ও ভোলা জেলায় প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়, যা মোট গম আবাদি জমির প্রায় ৩ শতাংশ। গমের জাত ও বপনের সময়ভেদে রোগের মাত্রা এবং ফলনের তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। এ রোগের কারণে আক্রান্ত গমের ফলন শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ কমে যায় এবং ক্ষেত্র বিশেষে কোনো কোনো ক্ষেতের ফসল প্রায় সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যায়। একই প্রজাতির ছত্রাক হলেও গমের প্যাথোটাইপ ধানে এবং ধানের প্যাথোটাইপ গমে ব্লাস্ট রোগ সংঘটিত করতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের কেনটাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং যুক্তরাজ্যের সেইনসবারি ল্যাবরেটরিতে ডিএনএ সিকোয়েনসিংয়ের মাধ্যমেও প্রমাণিত হয়েছে যে, বাংলাদেশ থেকে প্রেরিত গমের ব্লাস্ট রোগের জীবাণু ধানের ব্লাস্টের জীবাণু থেকে আলাদা। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের এবং গম গবেষণা কেন্দ্রের পরীক্ষায়ও দেখা গেছে যে, গমের ব্লাস্ট রোগের জীবাণু ধানের চারা গাছে এবং ধানের ব্লাস্ট রোগের জীবাণু গমের চারা গাছে রোগ সৃষ্টি করে না।
গমের ব্লাস্ট রোগের লক্ষণ
প্রাথমিক পর্যায়ে ব্লাস্ট আক্রান্ত গম ক্ষেতের কোনো কোনো স্থানে শীষ সাদা হয়ে যায় এবং অনুকূল আবহাওয়ায় তা অতি দ্রুত সারা ক্ষেতে ছড়িয়ে পড়ে। গমের কিছু শীষের উপরিভাগ শুকিয়ে সাদাটে বর্ণ ধারণ করে যা সহজেই নিম্নভাগের সবুজ ও সুস্থ অংশ থেকে আলাদা করা যায়; আবার কোনো কোনো শীষের প্রায় সম্পূর্ণ অংশই শুকিয়ে সাদাটে হয়ে যায়। এটি গমের ব্লাস্ট রোগের আদর্শ (Typical) লক্ষণ। প্রধানত গমের শীষে ছত্রাকের আক্রমণ হয়। শীষের আক্রান্ত স্থানে কালো দাগ পড়ে এবং আক্রান্ত স্থানের উপরের অংশ সাদা হয়ে যায়। তবে শীষের গোড়ায় আক্রমণ হলে পুরো শীষ শুকিয়ে সাদা হয়ে যায়। আক্রান্ত শীষের দানা অপুষ্ট হয় ও কুঁচকে যায় এবং দানা ধূসর বর্ণের হয়ে যায়। পাতায়ও ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ হতে পারে এবং এ ক্ষেত্রে পাতায় চোখের মতো ধূসর বর্ণের ছোট ছোট নেক্রোটিক দাগ পড়ে।
রোগের বিস্তার
আক্রান্ত বীজ এবং বাতাসের মাধ্যমে গমের ব্লাস্ট রোগ ছড়ায়। বৃষ্টির কারণে গমের শীষ ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা ভেজা থাকলে এবং তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস অথবা এর বেশি হলে এ রোগের সংক্রমণ হয় এবং রোগের জীবাণু দ্রুত বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
ব্লাস্ট রোগের জীবাণু কিছু ঘাস জাতীয় বিকল্প পোষক আগাছার যেমন- চাপড়া, শ্যামা, আংগুলি ঘাসের মধ্যে বাস করতে পারে; তবে সেখানে রোগের স্পষ্ট লক্ষণ সহজে দৃষ্টিগোচর হয় না। অনুকূল পরিবেশে বিকল্প পোষক আগাছায় ব্যাপকভাবে উৎপন্ন জীবাণু ব্লাস্ট রোগের মহামারী সৃষ্টি করতে পারে।
গমের ব্লাস্ট রোগ নিয়ন্ত্রণের উপায়
ব্লাস্টমুক্ত গমের ক্ষেত থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে;
অপেক্ষাকৃত কম সংবেদনশীল জাত বারি গম ২৮, বারি গম ৩০ এর চাষ করতে হবে;
উপযুক্ত সময়ে (অগ্রহায়ণের ০১ থেকে ১৫) বীজ বপন করতে হবে যাতে শীষ বের হওয়ার সময় বৃষ্টি ও উচ্চ তাপমাত্রা পরিহার করা যায়;
বপনের আগে প্রতি কেজি বীজের সাথে ৩ গ্রাম হারে প্রোভ্যাক্স ২০০ ডব্লিউপি অথবা ৩ মিলি হারে ভিটাফ্লো ২০০ এফএফ ছত্রাকনাশক মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। বীজ শোধন করলে গমের অন্যান্য বীজবাহিত রোগও দমন হবে এবং ফলন বৃদ্ধি;
গমের ক্ষেত ও আইল আগাছামুক্ত করতে হবে।
প্রতিষেধক ব্যবস্থা হিসেবে শীষ বের হওয়ার সময় একবার এবং এর ১২ থেকে ১৫ দিন পর আরেকবার ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে। প্রতি ৫ শতাংশ জমিতে ৬ গ্রাম নাটিভো ৭৫ ডব্লিউ জি-নভিটা ৭৫ ডব্লিউ জি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে। স্প্রে করলে গমের পাতা ঝলসানো রোগ, বীজের কালো দাগ রোগ এবং মরিচা রোগ দমন হবে। ছত্রাকনাশক ব্যবহারের সময় হাতে গ্লোভস এবং মুখে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে যাতে রাসায়নিক দ্রব্যাদি শরীরের সংস্পর্শে না আসে এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করতে না পারে।
রোগ ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা ও কর্মকৌশল
গমের ব্লাস্ট বাংলাদেশে নতুন হলেও রোগটি এদেশে গম চাষের ক্ষেত্রে একটি অন্যতম প্রধান অন্তরায় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। নতুন এ রোগটিকে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে এবং এর সঠিক ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে স্বল্পমেয়াদি কর্মকৌশল প্রণয়নের জন্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল কর্তৃক একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। বিশেষজ্ঞ গম বিজ্ঞানী, ডিএই, বিএডিসি, বারি, ব্রি, বিএইউ, সিমিট, ইউএসএআইডি এবং এফএও-এর প্রতিনিধি ছিলেন। টাস্কফোর্সের পরামর্শ অনুযায়ী সিমিটের সহায়তায় নেপালে একটি কনসালটেটিভ কর্মশালার আয়োজন করা হয় এবং দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে যেসব স্বল্পমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয় তাহলো-
০১. গমের নতুন জাতের বীজ সরবরাহ
উন্নতমানের রোগমুক্ত বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ। উন্নতমানের বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণের ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান এবং পরবর্তী বছরে কৃষক পর্যায়ে ভালো মানের বীজের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা। পরীক্ষাগারে ব্লাস্ট এবং অন্যান্য প্রধান রোগের উপস্থিতি শনাক্তকরণের জন্য বীজের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা।
০২. কৃষকের সচেতনতা বাড়ানো
নতুন রোগ বিধায় বাংলাদেশের কৃষক এবং অন্যান্য অংশীদারি জনগোষ্ঠীর মধ্যে গমের ব্লাস্ট রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ফ্যাক্টশিট-লিফলেট তৈরি করে ডিএই, বিএডিসি, সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সিমিট, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংশ্লিষ্ট ডিলারদের মাঝে বিতরণ;
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট এবং মোবাইল অ্যাপসে ফ্যাক্টশিট আপলোড করা ও ভিডিও চিত্র প্রদর্শন;
সচেতনতা বৃদ্ধির অংশ হিসেবে ডিএই, বিএডিসি, সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, অগ্রগামী কৃষক এবং বীজ কোম্পানির প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে গমের ব্লাস্ট রোগ ব্যবস্থাপনার ওপর কর্মশালার আয়োজন করা;
বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক গমের উৎপাদন ও বীজ সংরক্ষণ কলাকৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণে ব্লাস্ট রোগ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি অন্তর্ভুক্তিকরণ। রেডিও, টেলিভিশন ও মোবাইল মেসেজের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা।
০৩. সার্ভিলেন্স এবং মনিটরিং কার্যক্রম
গমের ব্লাস্ট আক্রান্ত এলাকাকে প্রাধান্য দিয়ে এ রোগের সংক্রমণ ও বিস্তার পর্যবেক্ষণ করা;
প্রতি বছর প্রায় ২০০টি গমের ক্ষেত ব্লাস্টসহ অন্যান্য রোগ সার্ভে এবং মনিটরিংয়ের আওতায় আনা;
বিএআরআইয়ের পরীক্ষাগারে সংগৃহীত নমুনাগুলো উপস্থিত ব্লাস্ট রোগের জীবাণু মাইক্রোসকোপ ও মলিকুলার মার্কারের সাহায্যে নিশ্চিত করা এবং ছত্রাকের আইসোলেট সংরক্ষণ;
জরিপের আওতাধীন এলাকার আবহাওয়ার তথ্য সংরক্ষণ করা এবং প্রতিটি গম ক্ষেত থেকে জিপিএস ডাটা সংগ্রহ করা;
রোগাক্রান্ত এবং রোগমুক্ত ফসলের তুলনার মাধ্যমে নির্বাচিত ক্ষেতগুলো ফলনের ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা। এ লক্ষ্যে গম পরিপক্ব হলে রোগাক্রান্ত এবং রোগমুক্ত উভয় প্লটের ফলনের উপাত্ত সংগ্রহ করা;
বাংলাদেশে কিছু ঘাস প্রজাতিতে ব্লাস্ট রোগের জীবাণুর উপস্থিতি দেখা যায়। এজন্য সার্ভিলেন্স এবং মনিটরিংয়ের সময় সন্দেহজনক বিকল্প পোষকগুলো শনাক্ত করা এবং ব্লাস্ট রোগের জীবাণুর উপস্থিতি পরীক্ষাগারে নিশ্চিত করা;
ব্লাস্ট রোগ সার্ভিলেন্স ও মনিটরিং এবং ব্যবস্থাপনা বিষয়ে দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানী ও মাঠ কর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রদান;
গবেষণা, সম্প্রসারণ ও বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সমন্বয়ে গ্রুপ গঠন করে সার্ভিলেন্স ও মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনা করা।
০৪. ছত্রাকনাশক সরবরাহ করা
গমের ব্লাস্ট রোগ দমনের জন্য প্রয়োজনীয় ছত্রাকনাশকের সরবরাহ নিশ্চিত করা যাতে সংশ্লিষ্ট চাষি সময়মতো ছত্রাকনাশক ক্রয় ও ব্যবহার করতে পারে।
০৫. গবেষণা কার্যক্রম
ব্লাস্ট আক্রান্ত এলাকায় মাঠ পর্যায়ে ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী গমের জাত-লাইন বাছাইকরণ ও মূল্যায়ন;
ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিমভাবে সংক্রমণ করে ব্লাস্ট প্রতিরোধী গমের অগ্রবর্তী লাইনগুলো শনাক্তকরণ ও নির্বাচন;
বীজ শোধন ও ফসলে স্প্রে করার জন্য নতুন ছত্রাকনাশকের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা;
গবেষণাগারে বীজ থেকে গাছে রোগ সংক্রমণ বিষয়ক গবেষণা করা;
শস্য ব্যবস্থাপনা যেমন- বপন সময়, বীজ শোধন, ফসলে স্প্রে, ফসলের অবশিষ্টাংশ ব্যবস্থাপনা, শস্য পর্যায় অনুসরণ এসবের মাধ্যমে সমন্বিত রোগ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি উদ্ভাবন করা।
০৬. বার্ষিক গবেষণা পর্যালোচনা
ব্লাস্ট রোগ ব্যবস্থাপনায় গৃহীত গবেষণা কার্যক্রমগুলো অগ্রগতি পর্যালোচনা এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা প্রণয়ন।
গমের ব্লাস্ট রোগ বীজবাহিত এবং বাতাসের মাধ্যমে এর জীবাণু ছড়ায় বিধায় বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে প্রথমবারের মতো এ রোগের আক্রমণ হলেও দেশের অন্যান্য অঞ্চলে এ রোগ বিস্তারের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তাছাড়া প্রতিবেশী দেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ১০০ মিলিয়ন টন গমের উৎপাদন ব্লাস্ট রোগের কারণে বাধগ্রস্ত হতে পারে এবং এ অঞ্চলের খাদ্য নিরাপত্তা ভীতির মুখে পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় গমের উৎপাদন বৃদ্ধি ও ফলন টেকসইকরণের লক্ষ্যে রোগ প্রতিরোধী জাতসহ গমের ব্লাস্ট রোগের অন্যান্য নিয়ন্ত্রণ কলাকৌশল উদ্ভাবন এবং দক্ষিণ এশিয়াসহ অনুরূপ আবহাওয়ার দেশগুলো এ রোগের বিস্তার রোধে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন একান্ত প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে এরই মধ্যে দেশি-বিদেশি গবেষণা ও অন্যান্য সহযোগী প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুতের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
ড. পরিতোষ কুমার মালাকার*
ড. নরেশ চন্দ্র দেব বর্মা**
*মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, **পরিচালক, গম গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, দিনাজপুর-৫২০০